গৃহবধূ থেকে গণতন্ত্রের প্রতীক বেগম খালেদা জিয়া

Loading...

গৃহবধূ থেকে গণতন্ত্রের প্রতীক বেগম খালেদা জিয়া

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া৷ একসময় তিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন৷ তার নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে৷

বাংলাদেশে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ৩০ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেছেন৷ মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর৷ খালেদা জিয়া এবং তার দল বিএনপি একসময় বাংলাদেশকে সেনা শাসন থেকে গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনার সংগ্রামের জন্য প্রশংসিত হয়েছিল৷

কাতারের সব আপডেট হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে ক্লিক করুন

Loading...

তবে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তার কয়েক বছর কারাভাগ করতে হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে৷ তার দল দাবি করে, জিয়ার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল৷ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর জিয়ার বিরুদ্ধে থাকা সব মামলার কার্যক্রম বাতিল হয়ে যায়৷

মুক্ত খালেদা জিয়া ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷

গৃহিনী থেকে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ

খালেদা জিয়া ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর পর বিশ্বের কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী৷ ১৯৮১ সালে তার স্বামী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হলে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন খালেদা জিয়া৷

জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি৷

রাজনীতিতে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও সেনা শাসনের বিরুদ্ধে বেসামরিক রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে দ্রুতই বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনীতিবিদে পরিনত হন বেগম খালেদা জিয়া৷

জিয়ার দল মধ্য-ডানপন্থি হলেও রাজনীতির মাঠে বাম এবং ডান দুই ঘরনার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে এরশাদের স্বৈরশাসনকে দুর্বল করে দিতে সক্ষম হন তিনি৷

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচনে জিয়ার দল ৩০০ আসনের মধ্যে ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে এবং খালেদা জিয়া প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন৷

কাতারে বিভিন্ন কোম্পানিতে নতুন চাকরির খবর

Loading...

নারীর ক্ষমতায়নে জিয়ার উদ্যোগ

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সংস্কারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া৷ বিশেষভাবে তিনি নারীর সাক্ষরতার হার বাড়াতে এবং তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হন৷ এজন্য তিনি মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন এবং বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন যেখানে বহু নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে৷

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে মেয়েদের স্কুলমুখী করতে বিনামূল্যে শিক্ষার পাশাপাশি শুধু তাদের জন্য আলাদা বৃত্তিরও ব্যবস্থা করে জিয়া সরকার৷ বিদেশি দাতাদের সহায়তায় স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে দুপুরের খাবার সরবরাহের উদ্যোগও নেয়া হয়৷ সব মিলিয়ে তার আমলে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের ভর্তির হার বেড়ে যায়৷

১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর মার্কিন পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখায় খালেদা জিয়া প্রশংসিত হন৷

কাতারের সব আপডেট হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে ক্লিক করুন

Loading...

পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নীতির সঙ্গে বৈসাদৃশ্যের বিষয়টি তুলে ধরে পত্রিকাটি লিখেছে, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম জিয়া অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণকে উৎসাহিত করেছেন, বিশেষ করে মেয়েদের মাঝে৷’

নিজের তৃতীয় মেয়াদে ২০০১ এবং ২০০৬ সালের মধ্যে কয়েক বছর মার্কিন ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিশ্বের ১০০ ক্ষমতাসীন নারীর তালিকায় স্থান পান বেগম খালেদা জিয়া৷

‘‘এক সময়ের লাজুক এবং চাপা স্বভাবের গৃহবধূ বেগম জিয়া, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিক্ষা খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন, বিশেষ করে নারী শিক্ষায়,” লিখেছে পত্রিকাটি৷

শেখ হাসিনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী

খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ দেশটিকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখলেও তিনি দ্রুতই বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিনত হন৷ তারা দুজন ১৭ কোটির বেশি মানুষের দেশটিকে ১৯৯১ সাল থেকে বিভিন্ন মেয়াদে শাসন করেছেন৷

রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে পশ্চিমা কূটনীতিকদের কাছে তারা পরিচিতি পান ‘‘ব্যাটলিং বেগমস” হিসেবে৷ বাংলাদেশের রাজনীতি গত কয়েক দশক ধরে কার্যত এই দুই নারীকে ঘিরে ঘুরপাক খেয়েছে৷

ওয়াশিংটনভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক মাইকেল কুগলম্যান বলেন, ‘‘আমি যখন খালেদা জিয়ার নাম শুনি, তখন প্রথমেই মনে আসে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা৷ জিয়া এবং হাসিনার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তা প্রভাব বিস্তার করেছে৷”

Loading...

‘‘ভুলের মাশুল” দিয়েছেন খালেদা জিয়া

২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট অবধি ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হন শেখ হাসিনা৷ তবে এই দীর্ঘমেয়াদে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের শুরুতে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করেও তেমন কোনো কঠোর রাজনৈতিক প্রতিরোধের মুখে পড়েননি তিনি৷

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে এসময় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন শেখ হাসিনা৷ আওয়ামী লীগের সেই টানা ক্ষমতায় থাকার মেয়াদে শুধু খালেদা জিয়া নন, বিএনপির প্রায় চল্লিশ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় দুইলাখের মতো মামলা করা হয়েছিল৷ দলটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সময়ে অন্তত ৬০০ নেতাকর্মী গুমের এবং তিন হাজার নেতাকর্মী বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন৷

Loading...

একসময় গণতন্ত্রের কঠোর সমর্থক জিয়া এই সময়ে শেখ হাসিনার দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রেখে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার প্রবণতা রুখতে পারেননি৷

‘‘গত দশকে অনেক ভুল করেছেন খালেদা জিয়া৷ নির্বাচন বর্জন করায় সুযোগ হারিয়েছেন৷ তার চেয়েও বড় কথা মধ্যপন্থা বাদ দিয়ে বিঘ্নকারী এবং সংঘর্ষমূলক অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি, যা অনেক সম্ভবনা নষ্ট করেছে,” ডয়চে ভেলেকে বলেন কুগলম্যান৷

Loading...

‘‘তার দল এক পর্যায়ে সহিংসতার পথ বেছে নেয় যা এক্ষেত্রে সহায়তা করেনি৷ তাছাড়া কখনো কখনো ইসলামিস্ট রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে যারা কট্টরপন্থি, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ এবং মধ্যপন্থার বাংলাদেশে বিশ্বাসীদের সমর্থন হারিয়েছেন,” যোগ করেন তিনি৷

ঢাকাভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ নজরুল মনে করেন, রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার শক্ত অবস্থান হারানোর পেছনে শেখ হাসিনার আমলে ভারতের এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম পশ্চিমা কূটনীতিকদের আত্মবিশ্বাস অর্জনে তার অনাগ্রহ ভূমিকা পালন করেছে৷

Loading...

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিবেশি দেশ ভারত বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে বলে বিশ্বাস করা হয়৷

‘‘২০১৩ সালে ঢাকায় ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাত না করার সিদ্ধান্ত এবং একই বছরে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে শেখ হাসিনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ায় তিনি রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন,” বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা হওয়ার আগে ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন নজরুল৷

Loading...

‘‘ঢাকাভিত্তিক অভিজাত বুদ্ধিজীবী এবং পশ্চিমা কূটনীতিকদের মন জয় করতে পারেননি তিনি৷ আর অতীতে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে লড়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকে বিএনপি এবং তার জোটদেরকে দূরে রাখতে না পারার ব্যর্থতাও তাকে দুর্বল করেছে,” বলেন তিনি৷

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদিও ধারণা করা হয় যে খালেদা জিয়ার বিপুল সমর্থক রয়েছেন, শেখ হাসিনা বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর সময়ে কৌশলে সেই ভোটারদেরকে ব্যালট বাক্স থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন৷

খালেদা জিয়াকে যেসব কারণে স্মরণ করা হবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লায়লা নূর ইসলাম মনে করেন, খালেদা জিয়া বাংলাদেশে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন৷

‘‘বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা করা, লাখ লাখ নারীকে পোশাক খাতে চাকুরির ব্যবস্থা করা, সবার জন্য বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গড়াসহ বিভিন্ন কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন,” ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷

Loading...

আসিফ নজরুল মনে করেন, খালেদা জিয়ার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই এবং সেই লড়াইয়ের কারণে জীবনের শেষ দিকে যে ভোগান্তির তিনি শিকার হয়েছেন, সেজন্য তিনি বহুযুগ মানুষের হৃদয়ে থাকবেন৷

‘‘খালেদা জিয়া চাইলে ২০০৬-২০০৭ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় কিংবা তার বিরুদ্ধে মামলা চলাকালীন সময়ে বিদেশে চলে যেতে পারতেন৷ তার বয়স হয়েছিল এবং তিনি অসুস্থ ছিলেন৷ তা সত্ত্বেও অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হবে বুঝেও তিনি হাসিনা সরকারের কাছে নতিস্বীকার করেননি এবং বিদেশে চলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেননি,” বলেন তিনি৷

ফেসবুকে আমাদের সাথে থাকতে লাইক দিন এখানে

Loading...

আরো পড়ুন

ডয়চে ভেলে

Loading...

Loading