বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের ১০ অনন্য রেকর্ড

Loading...

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের ১০ অনন্য রেকর্ড

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন এক ব্যতিক্রমী ও শক্তিশালী নাম। চার দশকের দীর্ঘ রাজনৈতিক পথচলায় তিনি দেখেছেন ক্ষমতার উত্থান-পতন, কারাবাস ও প্রবল রাজনৈতিক বৈরিতা। কিন্তু নির্বাচনের মাঠে জনতার রায়ে তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন নিজের অদম্য অবস্থান। সদ্য প্রয়াত এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু রাজনৈতিক রেকর্ড ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত রেখে গেছেন, যা তাকে দেশের সমসাময়িক সব রাজনীতিকের চেয়ে আলাদা উচ্চতায় স্থাপন করেছে।

নির্বাচনী সাফল্য থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনায় নেওয়া সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও বিরল রেকর্ড নিচে তুলে ধরা হলো।

১. নির্বাচনে কখনো পরাজিত না হওয়া নেতা
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রেকর্ড হলো—তিনি জীবনে কখনো কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে (১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনসহ) তিনি মোট ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং প্রতিটি আসনেই বিজয়ী হন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভিন্ন ভিন্ন এতগুলো আসন থেকে নির্বাচন করে শতভাগ সাফল্যের নজির আর কারও নেই।

২. পাঁচ আসনে জয়ের ‘হ্যাটট্রিক’
একসময় দেশের নির্বাচনী আইনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। সেই সুযোগে বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১, ১৯৯৬ (জুন) ও ২০০১ সালের নির্বাচনে পাঁচটি করে মোট ১৫টি আসনে দাঁড়িয়ে সবকটিতেই জয় পান। অর্থাৎ তিনি টানা তিন নির্বাচনে পাঁচ আসনে জয়ের বিরল ‘হ্যাটট্রিক’ করেন। আইন পরিবর্তনের পর ২০০৮ সালে তিনি তিনটি আসনে প্রার্থী হয়ে তিনটিতেই নির্বাচিত হন।

৩. ছয় ভিন্ন জেলা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত
দেশের শীর্ষ রাজনীতিকরা সাধারণত নিজ জেলা বা রাজধানীকেন্দ্রিক থাকলেও খালেদা জিয়া ব্যতিক্রম। তিনি বগুড়া, ফেনী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর ও খুলনাসহ দেশের ছয়টি ভিন্ন জেলা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। দেশের নানা প্রান্তের মানুষের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার এই ব্যাপক জনপ্রিয়তার রেকর্ডও তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করে।

৪. ফার্স্ট লেডি থেকে সরকারপ্রধান
বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র নারী, যিনি একই সঙ্গে ‘ফার্স্ট লেডি’ এবং পরে ‘প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী হিসেবে তিনি ছিলেন ফার্স্ট লেডি, আর পরবর্তীতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে হন দেশের সরকারপ্রধান। গৃহিণী থেকে রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হওয়ার এই যাত্রা রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল।

৫. সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের ভূমিকা
১৯৭৫ সালের পর দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা চালু ছিল। ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে বেগম খালেদা জিয়া দ্বাদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনেন। রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা বহাল রেখে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ থাকলেও তিনি সংসদকে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে ফিরিয়ে দেন—যা তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক।

৬. নারী শিক্ষায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ
নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে তার সরকারের সিদ্ধান্তগুলো ছিল বৈপ্লবিক। দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি চালুর মাধ্যমে দেশের নারীশিক্ষায় আমূল পরিবর্তন আসে। এই কর্মসূচি নারীদের কর্মজীবন ও সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং আন্তর্জাতিক মহলেও এটি একটি সফল ‘রোল মডেল’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

৭. মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা
২০০১ সালে তার সরকারই প্রথমবারের মতো ‘মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠন করে। স্বাধীনতার তিন দশক পর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। এটিও তার সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ।

৮. পলিথিন নিষিদ্ধের সাহসী সিদ্ধান্ত
পরিবেশ সুরক্ষায় ২০০২ সালে তার সরকার পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। বিশ্বের প্রথম দিকের দেশগুলোর একটি হিসেবে বাংলাদেশ এ সিদ্ধান্ত নেয়, যা সে সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয় এবং পরিবেশ আন্দোলনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

৯. সার্কের প্রথম নারী চেয়ারপারসন
১৯৯২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া সংস্থাটির প্রথম নারী চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। দক্ষিণ এশিয়ার মতো রক্ষণশীল অঞ্চলে এটি ছিল নারী নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

১০. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর গঠিত স্বল্পস্থায়ী সংসদে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করেন। এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের অংশ হয়। বিরোধী দলের দাবির প্রেক্ষিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ সুগম করতে এমন সাংবিধানিক পরিবর্তন রাজনীতিতে বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।

বর্ণাঢ্য এই রাজনৈতিক জীবন, নির্বাচনী সাফল্য ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার বেগম খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তার দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল রাজনৈতিক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলেও, রেখে যাওয়া এই রেকর্ডগুলো দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Loading...

Loading